‘প্রতিহিংসার আগুনে এখনও পুড়ছেন’ সংসদে দীপু মনি

পদ্মা সেতু হয়ে যাওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানাতে সংসদে তোলা প্রস্তাবের উপর আলোচনায় দাঁড়িয়ে নিজের বিরূপ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হওয়ার কথা বলেন তিনি।
গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইউনূসের নাম না নিয়ে দীপু মনি বলেন, “আইনের কাছে তিনি বেআইনি কাজ করায় হেরে গিয়ে এতটাই ক্ষুব্ধ হন যে শেখ হাসিনার সরকার, ব্যক্তি শেখ হাসিনা, তার পরিবার, তার বোন শেখ রেহানা এমনকি সরকার পক্ষের যিনি আইনজীবী ছিলেন, তার প্রতিও প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠেন।
“দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, কিছু মহলের প্রতিহিংসাপরায়ণতা এখনও প্রশমিত হয়নি। সেই আইনজীবীর স্ত্রী হিসেবে তাদের প্রতিহিংসার আগুনে আমাকে এখনো পুড়তে হয়।”
গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ হারানোর পর পদ্মা সেতুতে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধে ইউনূস তৎপরতা চালিয়েছিলেন বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবারই বলে আসছেন।
গ্রামীণ ব্যাংকের পদে থাকতে ইউনূস যে আইনি লড়াই চালিয়েছিলেন, সেই মামলায় তার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন দীপু মনির স্বামী তৌফিক নেওয়াজ।
দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্ব ব্যাংক যখন পদ্মা সেতু থেকে অর্থায়ন ফিরিয়ে নেয়, তখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন দীপু মনি।
সেই সময়কার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “যারা আমাদের মতো উন্নয়নের জন্য সংগ্রামরত দেশগুলোকে প্রতিনিয়ত স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার ছবক দেন, তাদের নেতৃস্থানীয় একটি রাষ্ট্রের ঢাকাস্থ রাষ্ট্রদূত এবং তাদের পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রায় উচ্চপর্যায়ের একজন কর্মকর্তা আমাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে আসেন।
“স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবার জন্য নয়, আসেন স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে অনুসন্ধানের যে কাজ আমরা হাতে নিয়েছিলাম তাকে বন্ধ করে দিতে। দুর্নীতির অনুসন্ধানকে উৎসাহিত করতে নয়। দুর্নীতির অনুসন্ধানকে বরং বন্ধ করে দিতে তারা চাপ প্রয়োগ করতে আসেন। স্বাভাবিকভাবেই এ রকমের কোনো অযাচিত অন্যায় চাপের কাছে শেখ হাসিনা সরকার নতি স্বীকার করেনি, করতে পারে না।”
দীপু মনি বলেন, “সেই রাষ্ট্রদূতসহ সেই দেশের অ্যাসিসটেন্ট সেক্রেটারি অব স্টেট আমার সাথে দেখা করে। আমি তখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলাম এবং ফোন করে তারা বারবার চাপ প্রয়োগ করতে থাকে এবং কখনও প্রচ্ছন্নভাবে, কখনওবা স্পষ্টভাবে বলে যে গ্রামীণ ব্যাংক এবং তার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বিষয়ে অনুসন্ধান বন্ধ করা না হলে পদ্মা সেতুর জন্য বিশ্ব ব্যাংক যে অর্থায়ন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তা বন্ধ করে দেওয়া হবে।
“এরপরই সব বায়বীয় অভিযোগ উত্থাপন করা হতে থাকে সরকারের বিরুদ্ধে এবং দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হয়। তারা তাদের কথা রেখেছিলেন, কোনো প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে, কোনো দাতা সহযোগীকে না জানিয়ে আকস্মিক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন করার যে সিদ্ধান্ত বিশ্ব ব্যাংক নিয়েছিল, সেটিকে তারা বন্ধ করে দেন।”
ক্লিনটন ফাউন্ডেশনে ইউনূসের অনুদান দেওয়ার অর্থের উৎস নিয়েও প্রশ্ন তোলেন দীপু মনি।
বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে দ্বন্দ্বের পর তাদের বাদ দিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করেছে বাংলাদেশ সরকার, আগামী ২৫ জুন বহু প্রতীক্ষিত সেই সেতু উদ্বোধন হবে।
দীপু মনি বলেন, “আজ সমস্ত প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে, সকল অসত্য আর ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে আমাদের পদ্মা সেতুর কাজ সম্পন্ন হয়েছে। স্বপ্ন আজ সত্যি।
“শেখ হাসিনাকে, তার পরিবারকে, তার সহকর্মীদেরকে হেয় করা সকল প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। কিন্তু শেখ হাসিনার সততা, দেশপ্রেম দৃঢ়তা, সাহস, প্রজ্ঞা আর দূরদর্শিতার কাছে পরাজিত হয়েছে সকল ষড়যন্ত্র। এই পদ্মা সেতু বাঙালির আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদার প্রতীক। বাঙালির সাহস আর দৃঢ়তার প্রতীক।”
পদ্মা সেতু ‘দুর্নীতির নিজর হয়ে থাকবে’
সংসদে আলোচনায় বিএনপির সংসদ সদস্যরা বলেন, পদ্মা সেতু দুর্নীতির নজির হয়ে থাকবে।
দলটির সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানা ‘অবিশ্বাস্য নির্মাণ ব্যয়ের’ একটি গল্প টেনে বলেন, লিথুয়ানিয়ার কৌনাস পৌরসভার ‘গোল্ডেন টয়লেটের’ মতো পদ্মা সেতু হবে বাংলাদেশের ‘গোল্ডেন ব্রিজ’।
তিনি বলেন, “লিথুয়ানিয়র কৌনাস পৌরসভার মেয়র শহরে একটি টয়লেট নির্মাণ করেছিলেন দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে। কাছাকাছি একটি টেনিস ক্লাবেএকই ধরনের টয়লেট বানায় সাড়ে চার লাখ টাকা খরচ করে। সেই কারণে মানুষ মজা করে সে টয়লেটকে বলত গোল্ডেন টয়লেট।
“একই রকম বা একটু বেশি দৈর্ঘ্যের অন্যান্য সেতুর সঙ্গে পদ্মা সেতুর মডেলের তুলনা করে, পদ্মা সেতুকে আমরা বলতেই পারি গোল্ডেন ব্রিজ। বাংলাদেশ গোল্ডেন ব্রিজ কেসও দুর্নীতির টেক্সটবুক এক্সাম্পল হয়ে থাকবে।”
রুমিন পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয়ে ৩০ হাজার কোটি টাকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, “ভারত, চীন, মালয়েশিয়ায় প্রতি কিলোমিটার সেতু তৈরি করতে খরচ পড়ে ৫শ’-৭শ’ কোটি টাকা। ঘরের পাশে ভূপেন হাজারিকা সেতুর দিকে তাকালে ৯ কিলোমিটারের সেতুতে নির্মাণ ব্যয় ১১শ’ কোটি রুপি। অর্থাৎ ভারতে একটা পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয় দিয়ে ৩০টা ভূপেন হাজারিকা সেতু নির্মাণ সম্ভব। ভারতে ১০ কিলোমিটারের যে সেতু নির্মাণ হচ্ছে ছয় লেন বিশিষ্ট, সে সেতুর খরচ হচ্ছে ৩ হাজার কোটি টাকা। লুটপাট আর কাকে বলে!”
পদ্মা সেতুর মতো এত বড় প্রকল্পের জন্য ঋণ নিতে না পারা সরকারের একটা বড় ব্যর্থতা বলে মন্তব্য করেন বিএনপির এই সংসদ সদস্য।
তিনি বলেন, “গর্বের জায়গা হল নিজের টাকায় সেতু তৈরি হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, ঋণের টাকায় যদি সেতু তৈরি হয়, সেটি বুঝি নিজের টাকায় নয়? ঋণ দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করাটাই স্বার্থের অনূকূল।
“আজকে এ সংসদে আলোচনা হয়েছে, বিশ্ব ব্যাংক আবার ফিরে এসেছিল। তাহলে বিশ্ব ব্যাংককে আবার নেওয়া হয়নি কেন? বিশ্ব ব্যাংকের ঋণ নিলে জবাবদিহিতা থাকতে হয়, এবং এ সরকার যে হরিলুট করেছে সেটা বিশ্ব ব্যাংকের ঋণ নিয়ে সম্ভব হত না।”
এই প্রসঙ্গে রুমিন আরও বলেন, “পদ্মা সেতু নিয়ে টিকটক ভিডিও করার কারণে একজনকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় মামলা, গ্রেপ্তার ও রিমান্ডেও নেওয়া হয়। তাহলে হলোকাস্ট ডিনায়াল অ্যক্টের মতো ডেভেলপমেন্ট ডিনায়াল অ্যাক্ট বা উন্নয়ন অস্বীকার আইন করা হোক।
“যে আইনে সরকারের বয়ানের সঙ্গে যারা একমত না হবেন, লুটপাটের বিরুদ্ধে যারা বলবেন, মানবাধিকারের কথা. ভোটের অধিকারের কথা বলে, ন্যায় বিচারের কথা বলে তাদেরকে ওই অ্যাকের আওতায় শাস্তি দিয়ে জেলেপুরে রাখা যাবে যতদিন খুশি ততদিন।”
বিএনপির সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ বলেন, “পদ্মা সেতু একটি বিরাট অর্জন, তাতে সন্দেহ নেই। প্রধানমন্ত্রী চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন। কিন্তু অনেক প্রশ্ন আছে, বিশ্ব ব্যাংক কেন অর্থায়ন করেনি, দফায় দফায় ব্যয় বেড়েছে। এসবের স্বচ্ছতা জবাবদিহি দরকার। বড় বড় প্রকল্পগুরো নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে।”
রুমিনের বক্তব্যের সময় সরকারি দলের সংসদ সদস্যরা হই চই করার বিষয়টি তুলে হারুন বলেন, “সংসদে আলোচনা হবে। সসরকারি দলের সদস্য বক্তব্য খণ্ডন করতে পারেন। কিন্তু যেভাবে হই চই হয়েছে, স্পিকার প্রটেকশন দেননি।”
পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধে বিএনপির ভূমিকা নিয়ে সরকার পক্ষের বক্তব্যের পাল্টায় তিনি বলেন, “বিশ্ব ব্যাংক কি বিএনপির কথায় টাকা দেয়? বিএনপি বিরোধী দল, ক্ষমতায় নেই, বিএনপি কীভাবে টাকা বন্ধ করে দেয়?”
সূত্র: বিডিনিউজ২৪.কম